পুলিশের কেনাকাটায় ‘দুর্বার’ ফ্যাসিবাদ আমলের ঠিকাদাররা, আর কত?

প্রকাশ | ১৯ মে ২০২৫, ২১:১৮

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস

বাংলাদেশ পুলিশের যেকোনো কেনাকাটায় ফ্যাসিবাদের আমলের ঠিকাদাররা এখনও সক্রিয় রয়েছেন। যেকোনো কেনাকাটায় তাদের প্রভাব এখনও কমেনি। হাজার কোটি টাকার কেনাকাটায় ঘুরে ফিরে আগের আমলের ঠিকাদাররাই কাজ বাগিয়ে নিচ্ছেন।

সূত্র বলছে, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও সেই আমলের ঠিকাদারদের কবল থেকে মুক্ত হতে পারছে না পুলিশ। এই তালিকায় রয়েছে— প্রভাবশালী দুজন সাবেক আইজিপির পছন্দের ঠিকাদার ও আত্মীয়, ছাত্রলীগের সাবেক একজন সভাপতি ও একাধিক ব্যবসায়ী গ্রুপ।

জানা গেছে, এসব ঠিকাদার চক্র এতটাই শক্তিশালী যে, তারা যেকোনো ভাবেই হোক পুলিশের কেনাকাটায় অংশ নিচ্ছে এবং কাজ বাগিয়ে নিচ্ছে। টেন্ডার হোক আর না হোক ঘুরে ফিরে নির্দিষ্ট কয়েকজনই কাজ পাচ্ছে। এমনকি তাদেরকে কাজ দিতে ২/৩ বার রি-টেন্ডার করা হচ্ছে। আবার এসব ঠিকাদার গ্রুপ একাধিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে টেন্ডারে অংশগ্রহণ করে; যা পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস-২০০৮’র পরিপন্থী। কাজ পেয়েই পুলিশকে যেমন খুশি তেমন পণ্য সরবরাহ করছে। ফলে পুলিশ গুণগত মালামাল পায় না।

যেসব ঠিকাদার এখনও বহাল:

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যেসব ঠিকাদার একচেটিয়া কাজ করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম সানজানা ফ্যাব্রিকস ও এইচ এক্স টেক্সটাইল মিলস। যার মালিক সোহরাব বাবু। তিনি বিগত সরকারের আমলে একচেটিয়া পুলিশের পোশাকের কাজ করেছেন। গতবছর কাপড়ের গুণগত মান ঠিক না থাকায় এখনো সেই কাপড় সরবরাহ করতে পারেননি বলে পুলিশ সদরদপ্তর সূত্রে জানা গেছে। এই সোহরাব বাবু দুইটি কোম্পানির মাধ্যমে কাপড় সরবরাহের কাজগুলো করতেন।

পুলিশের কেনাকাটায় সবচেয়ে বেশি যার নাম উচ্চারিত হয় তিনি হলেন আবুল কালাম আজাদ। মাল্টিট্রেড, ম্যাক ইন্টারন্যাশনাল, জেরিন টেক্স, লিথি এন্টারপ্রাইজ, ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি ছাড়াও একাধিক বেনামি কোম্পানির মালিক এই আজাদ। এসব কোম্পানি দিয়ে পুলিশে একচেটিয়া কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। গত এক দশক আগেও আজাদ পুলিশে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার কাজ করতে গিয়ে হিমশিম খেতেন। সেই আজাদ এখন প্রতিবছর অন্তত ১০০ কোটি টাকার ওপরে কাজ করেন। পুলিশের ইকুইপমেন্ট শাখা, আর্মস অ্যামুনেশন শাখা ও লজিস্টিকস শাখায় একচেটিয়া আধিপত্য এই আজাদের। বিগত সরকারের আমলে আজাদ তার একাধিক কোম্পানি দিয়ে পুলিশের বিভিন্ন শাখা থেকে অন্তত ৮০০ কোটি বেশি টাকার কাজ বাগিয়েছেন। যার কারণে সবাই তাকে পুলিশের কেনাকাটার ‘জায়ান্ট’ হিসেবে চেনেন।
এই আজাদকে বিভিন্ন সময় বলতে শোনা গেছে, ‘তিনি কোনো বছর কাজ না পেলেও ১০০ কোটি টাকার কাজ পাবেন। তিনি এমন কৌশল জানেন যার কারণে তাকে কাজ দিতেই হবে।’

একাধিক ঠিকাদার ঢাকাটাইমসকে জানিয়েছেন, সাবেক একজন প্রভাবশালী আইজিপির (বর্তমানে বিদেশে অবস্থানরত) আমলে এক লাখ পিস রেইনকোর্টের সরবরাহের কাজ বা কার্যাদেশ পেয়েছিল আজাদ। সেই রেইনকোর্ট ‘গ্রহণ কমিটি’ কর্তৃক একাধিকবার প্রত্যাখ্যাত হয়। তবে অদৃশ্য ক্ষমতাবলে সেই রেইনকোর্ট পুনরায় গ্রহণ করা হয়।

পুলিশের কেনাকাটায় আরেকটি আলোচিত নাম আওয়ামী লীগ নেতা আলী আশরাফ। তিনি গত বছর পুলিশের প্রায় ৫০ কোটি টাকার দুই লাখ পিস বুট সরবরাহের কাজ পান। তাকে এই কাজ দেওয়ার জন্য তিনবার রি-টেন্ডার দেওয়া হয়েছিল। আশরাফ দুই লাখ পিস বুট এখনও পুলিশকে বুঝিয়ে দিতে পারেননি। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে তিনি পুলিশে প্রায় আড়াই’শ কোটি টাকার কাজ করেছেন। 

বিগত সরকারের আমলে পুলিশের কেনাকাটায় আলোচিত-সমালোচিত ছিলেন ছাত্রলীগের সাবেক একজন সভাপতি। তিনি গত বছর প্রায় ৮০ কোটি টাকাসহ সবমিলিয়ে পুলিশে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার মতো কাজ করেন। পুলিশের বিভিন্ন রায়ট আইটেম (দাঙ্গা পুলিশের সরঞ্জাম) সহ একাধিক আইটেম সরবরাহ করতেন সাবেক এই সভাপতি। তাছাড়া আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি নূর মোহাম্মদের ভাই গোলাম মোহাম্মদ টিটু ও শুভও পুলিশের কেনাকাটায় অংশ নিয়ে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন। তারা পুলিশে প্রায় সাড়ে পাঁচশ কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নিয়েছিলেন। এখনও তারা পুলিশের কেনাকাটায় বহাল রয়েছেন।

পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা বা পিপিআর-২০০৮ এ স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, একই ব্যক্তি একাধিক কোম্পানির নাম ব্যবহার করে টেন্ডারে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। কেননা তাতে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট হয়। কিন্তু এসব ঠিকাদার একাধিক নাম ব্যবহার করে নামে-বেনামে কোম্পানি খুলেছেন। পরে সিন্ডিকেট করে কোটি কোটি টাকার কাজ করে যাচ্ছেন। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন হলেও এসব সরবরাহকারীদের অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। বরং তারা একচেটিয়া তাদের কাজগুলো করে যাচ্ছেন। এসব কোম্পানিগুলো পতিত সরকারের আমলে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে একচেটিয়া কাজ করে গেছেন। এখনো তারা নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছেন।

এসব বিষয় জানতে পুলিশ সদরদপ্তরের ডিআইজি (লজিস্টিকস) খন্দকার নজমুল হাসানকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তাতে তিনি সাড়া দেননি। একই দপ্তরের আরেক অতিরিক্ত ডিআইজি নাসিমা আক্তারকে ফোন করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।

 

(ঢাকাটাইমস/১৯মে/এসএস/এসএ)