স্টারলিংকের স্যাটেলাইট ইন্টারনেট যেভাবে কাজ করে, জানুন খরচ কত
প্রকাশ | ২১ মে ২০২৫, ০৯:০৯

তথ্য-প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহের কারণে বিশ্ব আজ হাতের মুঠোয়। তথ্য-প্রযুক্তির কারণে পুরো বিশ্ব এখন গ্লোবাল ভিলেজে রূপান্তরিত হয়েছে। বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করেছে বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ইলন মাস্কের স্পেসএক্সের স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা ‘স্টারলিংক’। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই ইতোমধ্যে চালু হওয়া এই পরিষেবা বাংলাদেশেও ফ্রিল্যান্সিং, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ব্যবসা খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দ্বার উন্মোচন করবে বলে মনে করা হচ্ছে। একইসঙ্গে নতুন এই প্রযুক্তি ঘিরে দেশের ইন্টারনেট সেবার মান এবং গ্রাহকসেবায়ও বড় ধরনের পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখা হচ্ছে।
বিশ্বের অধিকাংশ অঞ্চলেই মানুষ ক্যাবল ইন্টারনেট পরিষেবা ব্যবহার করে থাকে। ক্যাবল ইন্টারনেট সাধারণত সাবমেরিন ক্যাবল বা অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়।
তবে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট কোনো তার ছাড়াই সরাসরি স্যাটেলাইট থেকে সেবা দেয়া হয়। প্রত্যন্ত অঞ্চল বা গ্রামে যেখানে ফাইবার নেটওয়ার্ক স্থাপন করা কঠিন, সেখানে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা পাওয়া যেতে পারে।
স্যাটেলাইট ইন্টারনেট হল এক ধরনের ইন্টারনেট সংযোগ যা ব্যবহারকারীদের ইন্টারনেট অ্যাক্সেস প্রদান করতে স্যাটেলাইট ব্যবহার করে। এটি একটি গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে কক্ষপথের একটি উপগ্রহে ডেটা পাঠানোর মাধ্যমে কাজ করে, যা ব্যবহারকারীর অবস্থানে ইনস্টল করা একটি স্যাটেলাইট ডিশে ডেটা প্রেরণ করে। এই প্রযুক্তি গ্রামীণ বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিশেষভাবে উপযোগী যেখানে ঐতিহ্যবাহী কেবল বা ডিএসএল ইন্টারনেট পরিষেবা উপলব্ধ নাও হতে পারে।
মার্কিন প্রযুক্তি উদ্যোক্তা বিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ী ইলন মাস্কের মহাকাশযান নির্মাণ প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স। স্পেসএক্সের ইন্টারনেট সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান স্টারলিঙ্ক। স্টারলিংক মূলত জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইটের (ভূ–স্থির উপগ্রহ) মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার একটি প্রকল্প। এখন পর্যন্ত ৬০টি দেশে স্টারলিঙ্ক ইন্টারনেট সেবা দিচ্ছে। ইলন মাস্কের বাণিজ্যিক রকেট পরিষেবা প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স ২০১৯ সাল থেকে স্টারলিংক স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ শুরু করেছে। এরই মধ্যে তারা ৪ হাজার ৫১৯টি স্টারলিংক স্যাটেলাইট কক্ষপথে স্থাপন করেছে। প্রাথমিক পরিকল্পনায় প্রায় ১২ হাজার স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের কথা থাকলেও পরবর্তীতে ৪২ হাজারটি কক্ষপথে স্থাপনের কথা বলেছে স্পেসএক্স। এই স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবীতে অবস্থিত অ্যানটেনার মাধ্যমে ইন্টারনেট সরবরাহ করবে।
স্টারলিংকের স্যাটেলাইট অনেকটা স্যাটেলাইট টেলিভিশনের মতো কাজ করে। পৃথিবীর লো অরবিটে স্থাপিত অনেকগুলো ভূ–স্থির স্যাটেলাইট স্থাপন করা হয়। পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে ৩৫ হাজার ৭৮৬ কিলোমিটার ওপরে পৃথিবীর কক্ষপথে এসব স্যাটেলাইট স্থাপন করা হয়। স্যাটেলাইটগুলো মূলত টেলিভিশন, ইন্টারনেট, স্যাটেলাইট ফোন ইত্যাদিতে ব্যবহার করা হয়। অনেকগুলো ছোট ছোট স্যাটেলাইট পৃথিবীর কক্ষপথে নির্দিষ্ট স্থানে থেকে পৃথিবীর ঘূর্ণনের সমান গতিতে প্রদক্ষিণ করতে থাকে।
পৃথিবীর যে কোনো স্থান থেকে অন্য কোনো কম্পিউটারের সঙ্গে ইন্টারনেট যোগাযোগ করতে হলে, প্রথমে স্টারলিঙ্ক গ্রাহকের কম্পিউটার থেকে রিকোয়েস্ট কাছাকাছি স্যাটেলাইটে যায়। এরপর সেই রিকোয়েস্ট সেলুলার নেটওয়ার্কের মতো একটা থেকে আরেকটা স্যাটেলাইট হয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে (সার্ভার) পৌঁছায়। এরপর কাঙ্ক্ষিত তথ্য নিয়ে একই পদ্ধতিতে গ্রাহকের কম্পিউটারে (মোবাইল বা আইওটি) ফিরে আসবে। এভাবে পৃথিবীর যে কোনো স্থানে ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া যায়। এমনকি দুর্গম পাহাড় বা জঙ্গলেও ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া যাবে। ফলে পুরো পৃথিবী উচ্চগতির ইন্টারনেটের আওতায় আসবে।
স্টারলিঙ্ক ইন্টারনেট কানেকশন নিতে হলে টিভির ডিশ অ্যানটেনার মতো একটি অ্যানটেনা লাগাতে হয়। এই অ্যানটেনা স্যাটেলাইটের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। ওই অ্যানটেনা থেকে একটি ক্যাবল গ্রাহকের ঘরে রাখা স্টারলিঙ্কের ওয়াইফাই রাউটারে লাগিয়ে ইন্টারনেট উপভোগ করা যায়।
মঙ্গলবার (২০ মে) স্টারলিংক অফিসিয়ালি (আনুষ্ঠানিকভাবে) বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করেছে। বাংলাদেশের গ্রাহকরা এখন অর্ডার করতে পারবেন।
স্টারলিংকের খরচ বেশি হলেও এর মাধ্যমে প্রিমিয়াম গ্রাহকদের জন্য উচ্চমান এবং উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা প্রাপ্তির টেকসই বিকল্প তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি যেসব এলাকায় এখনো ফাইবার কিংবা দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা পৌঁছেনি, সেখানে কোম্পানিগুলো ব্যবসা সম্প্রসারণের সুযোগ পাবেন, এনজিও ফ্রিল্যান্সার এবং উদ্যোক্তারা বছরব্যাপী নিরবচ্ছিন্ন উচ্চগতির ইন্টারনেটের নিশ্চয়তা পাবেন।
স্টারলিংকের এই প্যাকেজগুলো মূলত এমন সব গ্রাহকের জন্য উপযোগী, যারা নিরবচ্ছিন্ন, উচ্চগতির ও নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট চান, বিশেষ করে দূরবর্তী, দুর্গম বা সীমান্তবর্তী অঞ্চলের জন্য এটি হতে পারে যুগান্তকারী একটি সমাধান।
স্টারলিংক বাংলাদেশে তাদের আনুষ্ঠানিক সেবা শুরুর পরপরই গ্রাহকদের জন্য দুটি প্যাকেজ চালু করেছে– রেসিডেন্সিয়াল ও রেসিডেন্সিয়াল লাইট। এ দুটির প্রতিটি নির্দিষ্ট প্রয়োজন ও সামর্থ্য অনুযায়ী গ্রাহকদের জন্য ভিন্ন সুবিধা দিচ্ছে।
রেসিডেন্সিয়াল প্যাকেজটির মাসিক খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে ৬০০০ টাকা। এটি মূলত উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যবহারকারী, গৃহস্থালি এবং ছোট অফিসের জন্য উপযোগী। অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত কম খরচে ইন্টারনেট সেবা পেতে আগ্রহী গ্রাহকদের জন্য রয়েছে রেসিডেন্সিয়াল লাইট প্যাকেজ, যার মাসিক খরচ ৪২০০ টাকা।
যেকোনো প্যাকেজ গ্রহণের জন্য গ্রাহককে শুরুতে এককালীন ৪৭ হাজার টাকা ব্যয় করে স্টারলিংকের সেটআপ কিট (যন্ত্রপাতি ও আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম) কিনতে হবে। এতে থাকবে স্যাটেলাইট ডিশ, রাউটার ও পাওয়ার সাপ্লাই ইত্যাদি, যা ইন্টারনেট সংযোগ স্থাপন নিশ্চিত করবে।
স্টারলিংকের সেবার সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো– এতে কোনো ডেটা সীমা বা গতি সীমা নেই। গ্রাহকরা নিরবচ্ছিন্নভাবে সর্বোচ্চ ৩০০ এমবিপিএস পর্যন্ত গতিতে আনলিমিটেড ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবেন। এটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এক অনন্য সংযোজন, যেখানে এখনো অনেক এলাকায় ব্রডব্যান্ড বা ফাইবার অপটিক ইন্টারনেট পৌঁছেনি।
(ঢাকাটাইমস/২১ মে/আরজেড)