খাবারে ক্ষতিকর মাইক্রোপ্লাস্টিক, শরীরে ঢুকছে বিষ
প্রকাশ | ২৭ মে ২০২৫, ০৯:৩১ | আপডেট: ২৭ মে ২০২৫, ১২:০৬

নিত্যব্যবহার্য প্লাস্টিক বর্জ্য, কলকারখানা থেকে নির্গত বর্জ্য পদার্থে মিশে থাকা প্লাস্টিক প্রতিনিয়ত মিশছে পরিবেশে। এসব প্লাস্টিক তাপমাত্রা, অণুজীব এবং নানা কারণে ভেঙে পরিণত হচ্ছে ক্ষুদ্র প্লাস্টিকে বা মাইক্রোপ্লাস্টিকে। যা পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এবং হুমকিস্বরূপ।
প্রতি বছর প্রায় আশি লক্ষ টন প্লাস্টিকের আবর্জনা নদী-নালা-খাল-বিল হয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে। এখনো পর্যন্ত যত প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়েছে তার সব যদি এক জায়গায় জড়ো করা হয় তবে সেই আবর্জনার স্তূপ পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টের চেয়েও উঁচু হবে। প্লাস্টিক আবর্জনার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রূপ হল মাইক্রোপ্লাস্টিক। আমাদের নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র থেকে মাইক্রোপ্লাস্টিক আমাদের শরীরে এবং রক্তে প্রবেশ করে। এমনকি সাম্প্রতিক সময়ে মায়ের বুকের দুধে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে। নীরব ঘাতক মাইক্রোপ্লাস্টিক মানবসভ্যতাকে এক নজিরবিহীন হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
প্লাস্টিকের অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি অংশ হচ্ছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। সাধারণত নারডল নামে পরিচিত। বাতাসে মাইক্রোপ্লাস্টিকের অন্যতম একটি উৎস ফসলি জমিতে ব্যবহৃত সার। এসব সার শুকিয়ে গেলে তাতে থাকা মাইক্রোপ্লাস্টিক বাতাস ও খাবারে মিশে যায় বলে বিজ্ঞানীদের দাবি।
সাধারণত ৫ মিলিমিটারের ছোট আকারের প্লাস্টিককে মাইক্রোপ্লাস্টিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অর্থাৎ এক ইঞ্চির প্রায় পাঁচ ভাগ ছোট আকৃতির প্লাস্টিক কণাকে মাইক্রোপ্লাস্টিক বলা হয়। তবে মানব স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ মাইক্রোপ্লাস্টিকগুলো আরো অনেক ছোট হয়। এমন সব অতিক্ষুদ্র মাইক্রোপ্লাস্টিক আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে, যা খালি চোখে দেখা যায় না। আমাদের সভ্যতা অনেকাংশেই প্লাস্টিক নির্ভর হয়ে পড়েছে। বর্তমানে প্লাস্টিক ছাড়া আপনি চলতেই পারবেন না। দিনের শুরু থেকে রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত আমরা প্লাস্টিকের বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করি। যেখানেই যাবেন সেখানে প্লাস্টিক। পানির বোতলগুলো সব প্লাস্টিকের। আমাদের বাজারের ব্যাগ প্লাস্টিকের। হোটেল-রেস্তোরাঁ খাবার প্লাস্টিকের পাত্রে তেল দেওয়া হয়। নিত্য প্রয়োজনীয় খাবার থেকে শুরু করে মুখরোচক খাবারের প্যাকেট প্লাস্টিকের। প্রতিদিন সকালে ব্যবহার করা টুথপেস্ট শুরু করে ফেসওয়াশ, বডি ওয়াশ, নেইলপলিশের মত প্রসাধনী এবং ডিটারজেন্ট পাউডারের মাইক্রোপ্লাস্টিক রয়েছে। এর বাইরেও বিভিন্ন ধরনের খাবারের মাধ্যমে মাইক্রোপ্লাস্টিক আমাদের শরীরে প্রবেশ করে।
স্বাস্থ্যকর খাবার ভেবে খাচ্ছেন, অথচ আপনার অলক্ষ্যেই সেই খাবারে মিশে শরীরে প্রবেশ করছে ‘মাইক্রোপ্লাস্টিক’। অর্থাৎ অতি ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা। স্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, মাইক্রোপ্লাস্টিক স্বাস্থ্যের জন্য ‘সাক্ষাৎ যম’। ক্যান্সার, হৃদরোগ, কিডনি জটিলতার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। সেইসঙ্গে আলঝেইমার্সের সমস্যা ও প্রজনন ক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে। মাইক্রোপ্লাস্টিক নিয়মিত শরীরে প্রবেশ করলে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতি করতে পারে, ডিএনএ-র ক্ষতি করতে পারে, প্রজনন ক্ষমতা কমাতে পারে এমনকি, কোষ নষ্টও করে দিতে পারে। কিন্তু মুশকিল হল, মাইক্রাপ্লাস্টিককে আটকানো মুশকিল। পরিবেশবিদেরাই বলছেন, এ যুগে মাইক্রোপ্লাস্টিকের শরীরে প্রবেশ অবধারিত। তাকে পুরোপুরি আটকানো যাবে না। কারণ, প্লাস্টিক কণা শুধু খাবারে মিশে নয়, ত্বকের রন্ধ্র এমনকি, শ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমেও শরীরে ঢুকতে পারে। তবে কিছু কিছু বিষয়ে সতর্ক হলে, অনেকটাই এড়ানো যেতে পারে মাইক্রোপ্লাস্টিককে।
সব সময় পানি ফিল্টার করুন
কলের পানিতেও মাইক্রোপ্লাস্টিক থাকতে পারে। তাই পানি সব সময় ফিল্টার করে খান। ফিল্টার মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণা অনেকটাই ছেঁকে ফেলে। ‘রিভার্স অসমোসিস’-এর মতো আধুনিক ফিল্টার পদ্ধতি এ ক্ষেত্রে আরও কার্যকরী।
বাইরের প্যাকেটজাত খাবার এড়িয়ে চলুন
বাড়িতে রান্না করা খাবার খান। বাইরে থেকে কেনা প্রক্রিয়াজাত বা প্যাকেটজাত খাবার যথাসম্ভব এড়িয়ে চলুন। প্লাস্টিকের পাত্র থেকে খাবারে প্লাস্টিক কণা মেশার সুযোগ থাকে। বিশেষ করে গরম খাবার প্লাস্টিকের পাত্রে থাকলে তা থেকেও খাবারে প্লাস্টিক কণা মেশার সুযোগ থাকে। বাড়িতে রান্না করা খাবার খেলে সেই বিপদ এড়ানো যায়।
ধাতব বা কাচের পাত্র ব্যবহার করুন
প্লাস্টিকের পাত্র ব্যবহার না করাই ভাল। বাড়িতেও যে কোনও খাবার রাখার ক্ষেত্রে কাচ বা ধাতব পাত্র ব্যবহার করুন। এগুলি অনেক বেশি নিরাপদ। কারণ, কাচ বা ধাতব পাত্র খাবারকে দূষিত করে না। কিন্তু প্লাস্টিক কোনও ভাবে গরম হলে বা ভেঙে গেলে খাবারে মিশতে পারে।
একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক বর্জন করুন
মাইক্রোপ্লাস্টিক সমস্যার আসল খলনায়ক হল গ্লাস, প্যাকেট, স্ট্র-এর মতো এক বার ব্যবহার্য প্লাস্টিক। প্যাকেটজাত খাবারের ক্ষেত্রে এই ধরনের প্লাস্টিকের ব্যবহার হয় বেশি। প্লাস্টিকের কাঁটা-চামচ, কৌটো, ট্রে ইত্যাদি এক বার ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া হয়। পরিবেশবিদেরা বলছেন, হয় পুনর্ব্যবহারযোগ্য জিনিস ব্যবহার করুন। অথবা পরিবেশবান্ধব জিনিসের ব্যবহার করুন।
পরিবেশবান্ধব ব্যাগের ব্যবহার
প্লাস্টিকের ব্যাগের ব্যবহার কমাতে পরিবেশবান্ধব ব্যাগ, যেমন চট বা সুতির ব্যাগ সঙ্গে রাখুন। সেগুলিই ব্যবহার করুন। পোশাক-আশাকের ক্ষেত্রেই সুতি, উল, লিনেনের পোশেক ব্যবহার করুন। পলিয়েস্টার জাতীয় পোশাক এড়িয়ে চলুন। একই জিনিস মাথায় রাখতে হবে নিত্যব্যবহারের তোয়ালে, বিছানার চাদর বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রেও।
সামুদ্রিক খাবারে প্লাস্টিকের উপস্থিতি
সামুদ্রিক মাছেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি দেখতে পেয়েছেন গবেষকেরা। মানুষের বর্জ্য বহু প্লাস্টিক গিয়ে জমছে সমুদ্রের পানিতে। সেই পানিতেই বেড়ে উঠছে মাছ অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণী। সমুদ্রের পানিতে থাকা মাইক্রোপ্লাস্টিক মাছের দেহবাহিত হয়ে মানুষের খাবারে মিশতেও পারে।
(ঢাকাটাইমস/২৭ মে/আরজেড)