প্রিয়জন হারানোর ভার সহ্য করা বড় কষ্টের…
প্রকাশ | ২৭ মে ২০২৫, ১২:১২ | আপডেট: ২৭ মে ২০২৫, ১২:১৭

মাত্র দুই দিন পর আমার আব্বার ২০তম মৃত্যুবার্ষিকী—একটি ক্ষণ, একটি অনুভব, একটি শূন্যতা, যা বিগত দুই দশক ধরে আমাকে নীরবে কাঁদিয়ে যাচ্ছে। সেই শোকের ভার এখনো বুকের গভীরে একেবারে তাজা। প্রতি বছর আব্বাকে হারানোর সময় ঘনিয়ে এলে তার স্মৃতি আরও তীব্র হয়ে চোখের সামনে ভেসে ওঠে—তার আদর, তার স্নেহ, তার কঠোর শাসন আর হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা—সবকিছুই যেন আজও জীবন্ত।
কিন্তু এ বছর এই শোকের আবহ আরও ঘন হয়ে এলো। আজ আমার প্রিয় চাচা রফিকুল আলম ইন্তেকাল করেছেন। তিনি ছিলেন আমার আব্বার ইমিডিয়েট ছোট ভাই। আমাদের পরিবারে চাচা-চাচিদের সম্মানসূচক ও স্নেহভরা নামে সম্বোধন করার একটি মায়াবি প্রথা রয়েছে, যা আমাদের পরিবারের সকলকে এক ভিন্নরকম আবেগ ও ভালোবাসার বন্ধনে বেঁধে রেখেছে।
যেমন– প্রয়াত বড় কাকাকে আমরা সম্বোধন করতাম ‘কাকাজান’, তার পরেরজন ছিলেন শুধু ‘কাকা’, আমার আব্বাকে ডাকা হতো ‘জাদুজান’ নামে। যিনি আজ ইন্তেকাল করেছেন, তাকে আমরা ডেকেছি ‘ধলাদুদুজান’ নামে, আর একমাত্র জীবিত চাচাকে সম্বোধন করি ‘দুদুজান’ বলে।
তেমনি চাচিদের মধ্যে বড় চাচিকে বলি ‘বড় চাচি আম্মা’, তার পরেরজন শুধুই ‘আম্মা’, আমার মাকে বলা হয় ‘রাঙা আম্মা’, তার পরেরজন ছিলেন ‘ধলা আম্মা’ এবং সবার ছোট চাচিকে বলা হয় ‘ছোট আম্মা’।
চাচাদের নামের শেষে ‘জান’ ও চাচিদের নামের শেষে ‘আম্মা’ যোগ করার মাধ্যমে পারিবারিক ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতা প্রতিফলিত হয়েছে। একে একে সেই স্নেহে ও সম্মানে ভরা প্রিয়জনেরা বিদায় নিয়েছেন পৃথিবী থেকে। এখন কেবল বেঁচে আছেন বড় চাচি আম্মা, আমার মা, দুদুজান ও ছোট আম্মা। প্রিয়জনদের এই শূন্যতা যে কতটা গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে, তা কেবল আমরা যারা তা অনুভব করছি, তারাই জানি।
প্রয়াত ধলাদুদুজান ছিলেন আমাদের পরিবারের আরেক অভিভাবকস্বরূপ। সরকারি চাকরিজীবী হয়েও তিনি ছিলেন আমাদের একান্ত আপনজন—সাধ্যানুযায়ী সবার পাশে ছায়ার মতো থাকা এক সংগ্রামী চরিত্র। তিনি ছিলেন আমার আব্বার স্মৃতির ধারক। আব্বার জীবনের বহু ঘটনা, নানা রকম স্মৃতি তিনি অনায়াসে আমাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতেন।
তিনি ছিলেন একজন জীবন্ত ইতিহাস। তার মুখে শোনা কিছু ঘটনা গা শিউরে ওঠার মতো ছিল, যা আমার চিন্তাভাবনাকেও নাড়িয়ে দিয়েছে বহুবার। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমাজের অসংগতি নিয়ে তিনি রচনা করেছেন অগণিত কবিতা ও ছড়া। যেগুলো ছিল নিছক তাঁর মনের খোরাক।
মাত্র ক’দিন আগেই স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ধলাদুদুজানকে দেখতে গিয়েছিলাম। প্রায় পঁচাশি বছর বয়সেও তিনি আমার নাম ধরে ডাকলেন। তার শুকনো খসখসে হাত দিয়ে মাথায় ও গায়ে স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিলেন। বারবার স্মরণ করলেন আমার আব্বার কথা, সাথে অন্য চাচাদের স্মৃতিও। এলোমেলোভাবে পরিবারজুড়ে নানা স্মৃতি হাতড়ে তিনি আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়লেন।
তার স্নেহ-মায়ায় মনের অজান্তেই আমার চোখ-মুখ ভারী হয়ে আসছিল। বিদায়ের মুহূর্তটি ছিল সত্যিই বর্ণনাতীত। আমাকে কাছে টেনে নিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে আমার হাতের কবজি চেপে ধরলেন। কিছুতেই যেন আমাকে যেতে দিতে চাইছিলেন না। আমাদের এই মায়াবী বন্ধন শুধু আমাকে নয়, আমার স্ত্রী-সন্তানদেরও আবেগে আপ্লুত করে তুলেছিল।
শেষবার বিদায় নেওয়ার আগে তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘তোমাকে আমি কত কোলে করেছি। তুমি কবে আসবা? আমাকে রেখে যেও না মাহবুব…’—এই বলে আবার আসার প্রতিশ্রুতি আদায়ের আকুতি জানালেন। এবার আর নিজেকে সামলাতে পারিনি। চোখের পানি গড়িয়ে বুক ভিজে গেল।
অবশেষে অনেক কষ্টে তার হাতের বাঁধন ছিন্ন করে তাকে কথা দিয়ে এলাম—‘কোনো এক শুক্রবারে আবার আসবো।’ কিন্তু ভাবিনি, তিনি আমাদের সকল বাঁধন ছিন্ন করে চিরদিনের জন্য আজই চলে যাবেন।
আব্বার মৃত্যুবার্ষিকীর মাত্র দুই দিন আগে আজ ধলাদুদুজানের বিদায়ে মনে হচ্ছে—আব্বাকে যেন আরও একবার হারালাম।
প্রিয়জন হারানোর এই যন্ত্রণা শব্দে প্রকাশ করা সম্ভব নয়—এ এক অন্তর্গত অনুভব, নিঃশব্দ অশ্রুতে হৃদয়ের গভীরে বয়ে চলা এক ব্যথা। সময় চলে যায়, মানুষ হারিয়ে যায়, কিন্তু তাদের রেখে যাওয়া ভালোবাসা, শিক্ষা ও স্মৃতি চিরদিন থেকে যায়।
আল্লাহ তাআলা আমার আব্বা, ধলাদুদুজানসহ আমাদের পরিবারের সব প্রয়াত সদস্যকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন। আর আমাদের এই কষ্টের সময়ে ধৈর্য ধারণ করার তাওফিক দিন। আমিন।
লেখক: ব্যাংকার ও উন্নয়ন গবেষক