মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগ

ইউসিবি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে সিআইডি, আরও আছে যেসব অভিযোগ

প্রকাশ | ২৭ মে ২০২৫, ১৮:১৫

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা টাইমস

মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগে অনন্ত গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) চেয়ারম্যান শরীফ জহিরের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ—সিআইডি। এরই মধ্যে শরীফ জহিরের কাছে বেশ কিছু নথি চাওয়া হয়েছে। সম্প্রতি সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট ও অর্গানাইজড ক্রাইম ইউনিট এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠায়।

এদিকে আলোচিত পানামা পেপারস অর্থ কেলেঙ্কারিতে নাম রয়েছে শরীফ জহিরের। ২০২২ সালে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট— বিএফআইইউ এবং বাংলাদেশ ব্যাংক একটি তালিকা আদালতে জমা দেয়। সেই তালিকার ১৬ নম্বরে নাম রয়েছে তার। অর্থপাচার ছাড়াও রাজস্ব ফাঁকি ও জমি দখলের মতো অভিযোগ আছে শরীফ জহিরের বিরুদ্ধে।

গত ২৭ এপ্রিল ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) চেয়ারম্যান শরীফ জহিরকে একটি চিঠি পাঠায় সিআইডি। যার বিষয় ছিল— মানিলন্ডারিং বিধি মোতাবেক সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে রেকর্ডপত্র সরবরাহ প্রসঙ্গে।

ওই চিঠিতে বলা হয়, আপনি ও আপনার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে জালিয়াতি, প্রতারণা ও বিদেশে অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের প্রাথমিক অভিযোগ রয়েছে। মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা-২০১৯ মোতাবেক আপনি ও আপনার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। অনুসন্ধানটি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য বেশকিছু তথ্য ও নথি প্রয়োজন।

চিঠিতে যেসব তথ্য চাওয়া হয়েছে

সিআইডি থেকে পাঠানো চিঠিতে শরীফ জহিরের কাছে বেশ কিছু তথ্য ও নথি চাওয়া হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে— 
১. শরীফ জহিরের স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, বাবা-মা,ভাই-বোন ও শ্বশুর শাশুড়ির নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর ও জাতীয় পরিচয়পত্র। 
২. স্ত্রী ও ছেলে-মেয়ের দেশি-বিদেশি পাসপোর্টের কপি। 
৩. ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, গার্মেন্টস বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা সম্বলিত তালিকা। 
৪. স্ত্রী ও ছেলে-মেয়ে ও বাবা-মায়ের ও প্রতিষ্ঠানের ১০ বছরের ট্যাক্স ফাইলের সত্যায়িত কপি। 
৫. দেশের বাইরে কোনো বিনিয়োগ, ব্যবসা, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি থাকলে সকল রেকর্ডপত্রের সত্যায়িত কপি। 
৬. বিদেশে বিনিয়োগ থাকলে সে সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেওয়া হয়েছে কি-না? অনুমোদন নেওয়া হলে সে সংক্রান্ত সকল রেকর্ডপত্রের সত্যায়িত কপি।

সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, শরীফ জহিরের বিরুদ্ধে প্রাথমিক তদন্তে বেশ কিছু অনিয়মের তথ্য মিলেছে। তবে তিনি তদন্তে অসযোগিতা করার চেষ্টা করছেন।

সিআইডির প্রধান (অতিরিক্ত আইজিপি) ছিবগাত উল্ল্যাহ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমি নতুন এসেছি। শরীফ জহিরের অনুসন্ধান কতদূর খোঁজ-খবর নিয়ে দেখবো।’

অভিযোগ বিষয়ে শরীফ জহিরের ব্যক্তিগত মোবাইলে একাধিকবার ফোন এবং খুদে বার্তা পাঠানো হলেও তার কোনো সাড়া দেননি। 

এদিকে গত ৩ ডিসেম্বর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড— এনবিআর থেকে দেশের ব্যাংকগুলোকে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। সেই চিঠিতে শরীফ জহির ও তার ভাই আসিফ জহিরের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। একইসঙ্গে তার মা কামরুন নাহারের ব্যাংক হিসাব স্থগিত রাখতে বলা হয়েছে। কর ফাঁকি সংক্রান্ত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের হিসাব জব্দ করার নির্দেশ দেয় এনবিআর।

অনন্ত গ্রুপের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

অনন্ত ডেনিম টেকনোলজি লিমিটেডের বিরুদ্ধে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে প্রায় ১০৩ কোটি ৬৯ লাখ ৬৬ হাজার ৩২৯ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ বেশ পুরাতন। প্রতিষ্ঠানটি বন্ড সুবিধায় আমদানি করা কাঁচামাল দিয়ে তৈরি পণ্য বিদেশে রপ্তানি না করে খোলা বাজারে বিক্রি করে দেয়।

জমি দখলের অভিযোগ

আক্তার হোসেন নামে এক ভুক্তভোগী অভিযোগ করেছেন, শরীফ জহির ও তার সহযোগীরা তার জমি অবৈধভাবে দখলের চেষ্টা করছেন। এ বিষয়ে তিনি ভাটারা থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। গত ২০ এপ্রিল ভাটারা থানায় করা সাধারণ ডায়েরিতে আক্তার হোসেন উল্লেখ করেছেন, অনন্ত রিয়েল এস্টেট লিমিটেড কোম্পানির নামে শরীফ জহির, ওমর মবিন, তামান্না রাব্বানী ও ব্রজানন্দ সরকার পরস্পর যোগসাজশে তার ক্ষতি ও হয়রানি করার নানা কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। যে সম্পত্তিতে তার কয়েক কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। বর্তমানে সেখানে কাজ করতে গেলে তাকে (আক্তার হোসেন) প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। যে কারণে তিনি পরিবার নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।

জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ ও অর্থপাচার

জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের অভিযোগে শরীফ জহিরের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরই মধ্যে দুদক অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ এবং বিএফআইইউ’র সহযোগিতা নিয়েছে।

আদালতের নির্দেশ অমান্য ও শ্রমিক নির্যাতন

আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও তার প্রতিষ্ঠিত অনন্ত টেরেসেস কোম্পানির মাধ্যমে নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। একইসঙ্গে জোরপূর্বক অন্যের জমি দখল, পোশাক কারখানার শ্রমিকদের সঠিক সময়ে বেতন না দেওয়া ও নির্যাতনসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে অনন্ত গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরীফ জহিরের বিরুদ্ধে।

এছাড়াও ২০১৯ সালে আদমজী ইপিজেডে অনন্ত গ্রুপের একটি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের নির্যাতন ও ছাঁটাইয়ের অভিযোগে সেখানকার শত শত শ্রমিক মানববন্ধনও করেছেন। সে সময় ওই পোশাক কারখানার প্রায় আড়াই হাজার শ্রমিককে পুলিশ দিয়ে নির্যাতন করানো হয়। এছাড়া বকেয়া পরিশোধ না করেই অন্তত দেড়শ শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয়।

শুল্ককর ফাঁকি ও বন্ড সুবিধার অপব্যবহার

অনন্ত গ্রুপের বিরুদ্ধে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার ও শুল্ককর ফাঁকির অভিযোগ রয়েছে। বলা হয়েছে, বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে প্রায় ১০৩ কোটি ৬৯ লাখ ৬৬ হাজার ৩২৯ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে অনন্ত গ্রুপ। তবে এ ধরনের কোনও অভিযোগ বা তথ্য এনবিআরের কাছে নেই। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজস্ব ফাঁকির ফাইল গাঁয়েব করে দেওয়া হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।

(ঢাকাটাইমস/২৭মে/এসএস/এমআর)