জমজম কূপ যেভাবে সাড়ে ৪০০ বছর পর ফিরে আসে, হারিয়ে গিয়েছিলই বা কেন

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম পানি জমজমের পানি। জমজম কূপের পানিকে ‘অত্যন্ত পবিত্র’ এবং ‘অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন’ বলে মনে করেন বিশ্বের মুসলিম। সৌদি আরবের মক্কায় মসজিদুল হারামের ভেতরে এই জমজম কূপটি অবস্থিত। মুসলিমদের কাছে পবিত্র হিসেবে বিবেচিত কাবাঘরের মাত্র ২০ মিটার দূরে এর অবস্থান।
হজ পালন করে এসেছেন অথচ জমজম কূপের পানি আনেনি এমন মানুষ বেশ বিরল। প্রতি বছর যে লাখ লাখ মুসলিম হজ বা ওমরাহ পালন করতে সৌদি আরবে যান তাদের বেশির ভাগই জমজম কূপের পানি নিয়ে দেশে ফেরেন।
ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী, জুরহুম গোত্র যখন মক্কা শাসন করছিল, তখন তাদের মধ্যে ধর্মীয় অবক্ষয় এবং পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। তারা কাবাঘরের পবিত্র মালামাল লুণ্ঠন ও চুরি করতে শুরু করে এবং জমজম কূপের পানি ব্যবহারে অন্যদের বাধা দিত। এই পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার কারণে আল্লাহর হুকুমে একসময় জমজম কূপের পানি শুকিয়ে যায় এবং সংস্কারের অভাবে একসময় কূপের স্থান বালি ও মাটি দিয়ে ভরাট হয়ে যায়। জুরহুম গোত্র খোজায়া গোত্র কর্তৃক ক্ষমতাচ্যুত ও বিতাড়িত হয়ে মক্কা ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় তারা কাবাঘরের জন্য হাদিয়াস্বরূপ রাখা কিছু মূল্যবান জিনিসপত্র, যেমন - সোনার দুটি হরিণ এবং কয়েকটি তলোয়ার জমজম কূপে নিক্ষেপ করে এবং কূপটি মাটি দিয়ে ভরাট করে ফেলে। এর ফলে কূপটি সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে যায় এবং মানুষ এর বরকত ও কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হতে থাকে।
এইভাবে, প্রায় সাড়ে চারশ বছর ধরে জমজম কূপ মানুষের চোখের আড়ালে মাটির নিচে চাপা পড়ে ছিল।
কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে একটি আর্টিকেল প্রকাশ করে। এটিতে বলা হয়েছে, সে সময় মক্কা ছিল জুরহুম গোত্রের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু তাদের পাপের কারণে তাদের উপর অভিশাপ নেমে আসে। হারিয়ে যায় জমজম কুয়া। ফলে তারা মক্কা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
রাসুল (সা.) এর দাদা আবদ আল মুত্তালিব পরবর্তীতে স্বপ্নে পেয়ে এটি পুনরায় আবিষ্কার করেন। এরপর থেকে এটির অস্তিত্ব বহমান ছিল। কারণ তখন মুহাম্মদ মক্কায় ইসলামের অভয়ারণ্য তৈরি করেছিলেন।
জমজম কূপ হারিয়ে যাওয়ার অনেক পরে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দাদা আব্দুল মুত্তালিব-এর সময়ে এটি আবার আবিষ্কৃত হয়। আব্দুল মুত্তালিব ছিলেন কুরাইশদের গোত্র প্রধান এবং তিনি অত্যন্ত ধার্মিক ও সম্মানী ব্যক্তি ছিলেন।
আব্দুল মুত্তালিব অনেক দিন ধরে জমজম কূপের সন্ধান করছিলেন, কিন্তু এর সঠিক অবস্থান কেউই জানত না। একদিন তিনি স্বপ্নযোগে আদিষ্ট হন। স্বপ্নে তাকে জমজম কূপ খননের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয় এবং কূপের সঠিক স্থানটিও নির্দিষ্ট করে দেখিয়ে দেওয়া হয়।
স্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে উঠে আব্দুল মুত্তালিব বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করেন এবং আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তার পুত্র হারেসকে (অন্য বর্ণনামতে যায়েদ বা অন্য পুত্র) সঙ্গে নিয়ে স্বপ্নে দেখানো স্থানে খননকার্য শুরু করেন। এই খননকাজ সহজ ছিল না, কারণ কূপটি বহু বছর ধরে মাটির নিচে চাপা পড়ে ছিল। খননকালে কিছু কুরাইশ নেতা আব্দুল মুত্তালিবের এই কাজে বিরোধিতা করেন এবং খননকাজে নিজেদের অংশীদারিত্ব দাবি করেন। কিন্তু আব্দুল মুত্তালিব তাদের বোঝান যে, এই কাজ তিনি আল্লাহর নির্দেশেই করছেন এবং এর জন্য তিনিই নির্বাচিত হয়েছেন।
ড. মাওলানা মো. আবু ছালেহ পাটোয়ারী বলেন, ‘জমজম কূপ একসময় ময়লা আবর্জনায় কালের গ্রাসে হারিয়ে যায়। রাসুলের দাদা আব্দুল মুত্তালিব দীর্ঘদিন খুঁজেও পাচ্ছিলেন না। একদিন তাকে স্বপ্নে দেখানো হলো প্রিয় সন্তানকে কোরবানি দিলে এর সন্ধান দেওয়া হবে। তার সন্তানদের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় ছিল রাসুলের বাবা আব্দুল্লাহ। তার অন্য ছেলেরা এই ছেলেকে কোরবানি দিতে নিষেধ করে, ১০০ উট কোরবানি দেওয়ার কথা বলে। এরপর ১০০ উট কোরবানি দেওয়ার কথা বললে আল্লাহ আবার জমজম কূপের পানি বের হওয়ার নির্দেশ দেন। সেই থেকে এটির পানির প্রবাহ হাজার হাজার বছর ধরে চলছে।
খননকাজ চলাকালে আব্দুল মুত্তালিব জুরহুম গোত্রের ফেলে যাওয়া কিছু জিনিসপত্র, যেমন - কিছু সংখ্যক তলোয়ার ও লৌহবর্ম এবং দুটি সোনার হরিণ খুঁজে পান। এই মূল্যবান জিনিসগুলো প্রাপ্তি তার দাবির সত্যতা প্রমাণ করে। এরপর তিনি এই তলোয়ারগুলো দ্বারা কাবাঘরের দরজা ঢালাই করেন এবং সোনার হরিণ দুটি কাবাঘরের দরজার সঙ্গে স্থাপন করেন।
অবশেষে, আব্দুল মুত্তালিবের নিরলস প্রচেষ্টা এবং আল্লাহর কুদরতে জমজম কূপের পবিত্র পানি পুনরায় প্রবাহিত হতে শুরু করে। কূপটি আবার আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকে এটি আবার মানুষের জন্য উন্মুক্ত হয় এবং তখন থেকেই হজযাত্রী ও ওমরাহ পালনকারীরা এই পবিত্র পানি পান করার সুযোগ পান। আব্দুল মুত্তালিব এরপর থেকে হাজীদের জমজম কূপের পানি পান করানোর ব্যবস্থা করেন।
এভাবেই আব্দুল মুত্তালিবের হাত ধরে জমজম কূপ আবার পৃথিবীর বুকে ফিরে আসে এবং মুসলিম উম্মাহর জন্য এক বরকতময় উৎসের সৃষ্টি হয়।
'সৌদি গেজেট' সংবাদপত্র অনুযায়ী, জমজমের কূপটিকে বিশ্বের 'প্রাচীনতম কূপ' বলে ধারণা করা হয়। কারণ গত পাঁচ হাজার বছর ধরে এখান থেকে একটানা পানি পাওয়া যাচ্ছে।
সৌদি আরবের জিওলজিক্যাল সার্ভে-র জমজম স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার এই পানির কুয়োর মান, গভীরতা, অম্লতার মাত্রা বা তাপমাত্রার দিকে নিয়মিত নজর রাখে। জমজম স্টাডিজ এন্ড রিসার্চ সেন্টার এই কূপের পানি সরবরাহ ও বণ্টন ব্যবস্থা পরিচালনা করে। এটি মক্কা ও মদিনায় ফিল্টারিং ও স্টোরেজ প্ল্যান্টের পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের গুনমানের নিশ্চয়তা বিধান করে। এটি ত্রিশ মিটার গভীর। তারপরেও এটি প্রতি সেকেন্ডে সাড়ে আঠারো লিটার পানি পাম্প করতে পারে।
কুদাই থেকে মদিনার বাদশাহ আবদুল আজিজ সাবিল জলাধারে প্রতিদিন ট্যাঙ্কার ট্রাকের একটি বহর চার লাখ লিটার পর্যন্ত পানি পরিবহন করা হয়। এর ধারণক্ষমতা ১৬ হাজার ঘনমিটার। এখান থেকে নবীর মসজিদে পানি সরবরাহ করা হয়। পরিবহনের সময় পানি যাতে কোনোভাবে দূষিত না হয়, সেদিকেও লক্ষ্য রাখা হয়।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘ভূপৃষ্ঠের শ্রেষ্ঠ পানি জমজম। এতে রয়েছে খাদ্যের বৈশিষ্ট্য ও রোগ থেকে মুক্তি।
আরও বর্ণিত হয়েছে, ‘যে উদ্দেশ্যে জমজম পান করা হবে তা পূরণ হবে। যদি তুমি রোগমুক্তির জন্য তা পান কর আল্লাহ তোমাকে সুস্থ করে দেবেন।
জমজম কূপের পানি আল্লাহর কুদরতের বিস্ময়কর নিদর্শন। জমজমের এক ফোঁটা পানির যে নিজস্ব খনিজ গুণাগুণ আছে, তা পৃথিবীর অন্য কোনো পানিতে নেই। জমজম কূপের পানি, তার উৎস এবং অদ্যাবধি পানির ধারা বহমান থাকা আল্লাহর অশেষ কুদরতের বহিঃপ্রকাশ।
(ঢাকাটাইমস/৯ জুন/আরজেড)
সংবাদটি শেয়ার করুন
ধর্ম বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
ধর্ম এর সর্বশেষ

দেশে ফিরছেন আরও পৌনে ৪ হাজার হাজি

হজের খুতবায় মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধভাবে থাকার আহ্বান

কুরবানির পশু জবাই করার সঠিক নিয়ম পদ্ধতি

যেসব কারণে কোরবানি কবুল হয় না

কোরবানির পশুর যেসব অঙ্গ খাওয়া ইসলামে নিষেধ

আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরবানির পশু নির্বাচনে ইসলামের নির্দেশনা

বাংলাদেশি হাজীদের সেবায় মিনায় দায়িত্ব পালন করবে ১৮ টীম

কোরবানি দিতে না পারলে কী করবেন: ইসলাম কী বলে?

ঈদুল আজহার প্রস্তুতি: তাকবিরে তাশরিক কখন থেকে কীভাবে পড়তে হয়
