যেভাবে আওয়ামী লীগ বিরোধী মুখ হয়ে ওঠেন আন্দালিব পার্থ

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ১৫ মে ২০২৫, ১৭:৫০ | প্রকাশিত : ১৫ মে ২০২৫, ১৩:৪৯

তাকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। বিরোধী মত দমনে দেশজুড়ে সরকারের চরম দমন-পীড়নের সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কট্টর সমালোচক ছিলেন তিনি। হয়ে উঠেছিলেন দুর্নীতি-অনিয়ম, অপশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মুখ।

অথচ তার শরীরে বইছে শেখ পরিবারের রক্ত। তার মা রেবা রহমান শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নি। নিজে বিয়ে করেছেন শেখ মজিবের আপন চাচাতো ভাইয়ের মেয়েকে। পারিবারিক এই সম্পর্ক সূত্রে শেখ হাসিনা হন তার ফুফু। আওয়ামী লীগ সরকারের এই একনায়ক প্রধানমন্ত্রী ফুফুকে ছেড়েও কথা বলেননি ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ।

কীভাবে এমন আওয়ামী লীগবিরোধী কণ্ঠ হয়ে ওঠেন গত প্রায় দেড় যুগ ধরে তরুণদের আইডল বনে যাওয়া এই তরুণ রাজনীতিক? কীভাবেই বা উপেক্ষা করতে পেরেছেন এমন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তার চাপ?

বিগত দিনগুলো পর্যালোচনায় দেখা যায়, তার রাজনীতির শুরু থেকেই ছিল আওয়ামী লীগের বিরোধিতা। বিশেষ করে যখন পিতৃবিয়োগের পর নিজ দলের প্রধানের দায়িত্ব কাঁধে চাপে, তখন বিস্তৃত পরিসরে প্রকাশিত হতে থাকে তার আওয়ামী-বিরোধিতার বয়ান। দুর্দণ্ড প্রতাপশালী আওয়ামী লীগ সরকারের রক্তচক্ষু এতটুকু বিব্রত করতে পারেনি তাকে।

তার বয়স তখন কতইবা। জাতীয় রাজনীতিতে হাতে খড়ি ২৬ বছর বয়সে ২০০০ সালে, বাবা নাজিউর রহমান মঞ্জুরের বাংলাদেশ জাতীয় পার্টিতে। আর ২০০৮ সালে বাবার মৃত্যুর পর দলের নেতত্বভার নেন ৩৪ বছর বয়সে। তখন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়কের কাল। রাজনীতিকদের জন্য এক কঠিন সময় মনে করা হয় সেটাকে। তখনও পার্থ ছিলেন সোচ্চার। বছর শেষে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হন তার রক্তসম্পর্কের আত্মীয় শেখ হাসিনা। এবার দেখা মেলে আরেক রুদ্রমূর্তি আন্দালিব রহমানের।

অথচ তার তখনকার বয়সটা ক্ষমতাচর্চা আর লিডারশিপের জন্য মোহগ্রস্ত থাকার সময়। মানবীয় এই প্রবৃত্তি ও নিজের যোগ্যতা বিবেচনায় চাইলেই ক্ষমতার ভরকেন্দ্রে যেতে পারতেন তিনি। নানা সময়ে এ-সংক্রান্ত প্রস্তাবও গেছে শেখ হাসিনার তরফে। কিন্তু তিনি বেছে নেন দুর্নীতিগ্রস্ত ক্ষমতাকে চোখ রাঙানোর কাজটি। সংসদে সরকারের সমালোচনা করে কাঁপিয়ে দেন ট্রেজারি বেঞ্চ। আর তাতে দেশজুড়ে হয়ে ওঠেন দল-মতনির্বিশেষে জনপ্রিয় মুখ।

শেখ পরিবারের সদস্য হয়েও আওয়ামী লীগের বিরোধিতা আর প্রতিবাদ করতে গিয়ে তাকে কম কথা শুনতে হয়নি দলটির নেতাদের কাছ থেকে, এমনকি খোদ শেখ হাসিনা তাকে ইঙ্গিত করে বাজে ভাষায় মন্তব্য করেছেন এমন নজিরও আছে। ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের দিয়ে তাকে বাগে আনার চেষ্টা হলেও নিজ আদর্শ, দর্শন, ভাবনা থেকে নড়েননি ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ।

তাকে থামাতে তার বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। কিন্তু তাতে নিজের পথ থেকে বিচ্যুত হননি এক চুলও। বরং দিন দিন শানিত হয়েছে তার দুর্নীতিবিরোধী কণ্ঠ, উচ্চকিত হয়েছে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের বার্তা। যখন যেখানে সুযোগ পেয়েছেন সোচ্চারে তুলে ধরেছেন এসব। যেমন সংসদে, তেমনি টিভির টকশোতে এই বাগ্মী মানুষটি যেন জনগণের কণ্ঠ হয়ে ওঠেন। হয়ে ওঠেন দুর্নীতিগ্রস্ত আওয়ামী লীগের বিরোধী মুখ। দেশের মানুষ যেন তার কণ্ঠে খুঁজে পান নিজেদের অব্যক্ত বয়ান।

সর্বশেষ জুলাই আন্দোলন যখন তুঙ্গে, শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের দাবি উঠে গেছে রাজপথে ছাত্র-জনতার মিছিলে। ক্ষমতাসীন দল ও সরকারি বাহিনীর দমন-পীড়ন ও হামলার ঘটনাও বাড়ছে সমানতালে। সরকারবিরোধী বিক্ষোভ ছড়াতে থাকে জনে জনে। এতে সরকারের সন্দেহের তীর ছোটে আন্দালিব রহমান পার্থের দিকে। ২৪ জুলাই রাতে তাকে ধরে নিয়ে জেলে পোরে সরকার। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ছাত্র-জনতাকে সরকারের বিরুদ্ধে উসকে দিয়েছেন তিনি।

একটু পেছন ফিরে যাওয়া যাক। সময়টা ২০০৯ থেকে ২০১৪। তার আগে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচনে ভোলা-১ আসনে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ইউসুফ হোসেন হুমায়ুনকে পরাজিত করে প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেই সংসদ সদস্য হন আন্দালিব পার্থ।

এরপরই অন্যরকম এক তরুণ সদস্যকে সংসদে দেখতে পেল জাতি। অসাধারণ বাগ্মিতায় সংসদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে সমালোচনার তিরে বিদ্ধ করতে থাকেন তিনি। সংসদে উপস্থিত সংসদ নেতা শেখ হাসিনার কঠোর সমালোচনাতেও পিছপা হননি কখনো।

২০১০ সালের শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির পেছনে কার হাত ছিল, কারা কত টাকা লুটে নিয়েছে, সবিস্তারে তুলে ধরেন সংসদে। শেয়ারবাজারে দরবেশ উপাধি পাওয়া শেখ হাসিনার বিনিয়োগ উপদেষ্টার সিন্ডিকেট আর কারসাজির কারণে কত বিনিয়োগকারী সর্বস্বান্ত হয়েছে নথিসহ তারও তথ্য তুলে ধরেন, এর জবাব চান শেখ হাসিনার কাছে। সংসদে নিজের আসনে বসা সংসদ নেতা বিস্ময় চোখে শুনে যান নবীন সংসদ সদস্যের জ্বালাময়ী বক্তব্য।

পার্থর বাবা নাজিউর রহমান মঞ্জুরও ছিলেন প্রভাবশালী রাজনীতিক। বীর মুক্তিযোদ্ধা নাজিউর রহমান মঞ্জুর এরশাদের আমলে ছিলেন জাতীয় সংসদে ভোলা-১ আসনের সংসদ সদস্য, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীও হয়েছিলেন এরশাদের ক্যাবিনেটে। দ্বীপজেলা ভোলার উন্নয়নে তার অবদানের কথা এখনো স্মরণ করে সেখানকার মানুষ।

জাতীয় পার্টি বিভক্ত হয়ে গেলে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) নাম নিয়ে একটি অংশের নেতৃত্ব দেন নাজিউর রহমান মঞ্জুর। বাবার হাত ধরেই রাজনীতিতে পা রাখেন যুক্তরাজ্য থেকে পড়াশোনা করে আসা ব্যারিস্টার আন্দালিব পার্থ।

২০০৮ সালে নাজিউর রহমান মঞ্জুর মারা গেলে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হন মাত্র ত্রিশ ছাড়ানো পার্থ। দল ছিল বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের শরিক। পরবর্তী সময়ও বিএনপি জোটে তাদের গাঁটছড়া ছিল অটুট। আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাচারে হারানো গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনার আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যান ঐক্যবদ্ধভাবে।

এ সময় কী জনসভায়, কি টিভি টক শো, কিংবা সাক্ষাৎকার- তার ক্ষুরধার ও যুক্তিশীল বক্তব্য শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের সহজেই মনোযোগ কাড়ে। টেলিভিশনের টক শোতে যুক্তির পিঠে যুক্তি সাজিয়ে তার ফুফুর দল ও সরকারের তুলোধুনা করেন যুক্তরাজ্য থেকে ব্যারিস্টারি করা পার্থ।

বিএনপির সাথে ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে আন্দালিবের দলও। ২০১৮ সালে রাজধানী ঢাকার ১৭ নম্বর আসন থেকে জোটের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন আন্দালিব পার্থ। তবে সরকার ভোটের আগের রাতেই বাক্স ভরে আবারও কালিমালিপ্ত করে নির্বাচনকে। বিরোধী দলের কারোই জয়ের সুযোগ ছিল না তাতে। তবে সংসদ সদস্য না হলেও চুপ করে থাকেননি আন্দালিব পার্থ। সরকারি দলের সদস্যদের দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি, বিরোধী দলের ওপর হামলা-মামলা, দমন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে বলিষ্ঠ কণ্ঠে প্রতিবাদ জানিয়ে গেছেন অবিরাম।

৫ আগস্টের পর নতুন বাংলাদেশেও আওযামী লীগের বিরোধিতা শেষ হয়ে যায়নি এই তেজস্বী নেতার। তিনি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে আসছিলেন গণঅভ্যুত্থানের পর থেকেই। এমনকি প্রয়োজনে জুলাই গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার জন্য সংবিধানে আলাদা বিধান সংযোজনের প্রস্তাব দেবেন বলেন তিনি। তার কথা, গণহত্যার জন্য যাদের অনুশোচনা নেই, তারা রাজনীতি করার অধিকার হারিয়েছে।

জনদাবির পরিপ্রেক্ষিতে ইতিমধ্যে সরকার আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সব ধরনের কারক্রম নিষিদ্ধ করেছে। এর জন্য সরকারকে বিদ্যমান সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দল-সংগঠনের অপরাধের বিচারের বিধান যুক্ত করে সন্ত্রাসবিরোধী (সংশোধন) অধ্যাদেশ জারি করতে হয়।

এ হেন আওয়ামীবিরোধী মুখ আন্দালিব রহমান পার্থ এবার নিজেই মিডিয়ায় খবর হলেন শেখ পরিবারের আত্মীয়তার কারণে। শেখ পরিবারের সদস্য তার স্ত্রী শেখ সাইরা রহমান বিদেশ যাওয়ার সময় বিমানবন্দর থেকে তাকে ফিরিয়ে দেয় সরকার।

এ বিষয়ে জানা যায়, শেখ পরিবারের সব সদস্যের তালিকা করেছে সরকার, যেটি বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে দেওয়া আছে। স্বাভাবিকভাবেই সাইরা রহমানের নামও এসে গেছে সেখানে।

৫ আগস্ট জনরোষে শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেওয়ার আগে-পরে শেখ পরিবারের প্রায় সবাই দেশ ছাড়েন। সাইরা রহমানের বাবা শেখ হেলাল, তার চাচা, ভাই সবাই এখন দেশের বাইরে।

নাজিউর রহমান মঞ্জুর ও শেখ রেবা দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে পার্থ সবার বড়। দ্বিতীয়জন ড. আশিকুর রহমান শান্ত একজন অর্থনীতিবিদ, আর সবার ছোট ওয়াছিকুর রহমান অঞ্জন ব্যারিস্টার।

(ঢঅকাটাইমস/১৫মে/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

রাজনীতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

রাজনীতি এর সর্বশেষ

স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য এভারকেয়ার হাসপাতালে খালেদা জিয়া

এনসিসি গঠন ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ইলেকট্রোরাল কলেজ গঠনে এবি পার্টি সম্মত

ত্যাগী পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের সর্বোচ্চ মূল্যায়ন করবে বিএনপি: আমিনুল হক

যেদিন হাসিনা পালিয়েছেন, সেদিনই আওয়ামী লীগ বিলুপ্ত: রাশেদ খান 

বিএনপিতে আওয়ামী লীগের স্থান হবে না: মির্জা ফখরুল

অপরাধ করলে আমাকে গ্রেপ্তার করুন, আসিফকে ইশরাক

এনসিসিতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতিকে না রাখার পক্ষে জামায়াত

নির্বাচন নিয়ে সরকারের প্রতিশ্রুতি দ্রুত বাস্তবায়ন হবে, আশা রিজভীর 

সন্ধ্যায় হাসপাতালে যাবেন খালেদা জিয়া

গুলশানের নিজ বাড়িতেই উঠবেন তারেক রহমান 

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :