দিনের পর রাতও পেরিয়ে যায়, দেলোয়ার ফেরেন না...

সেই দিনটা ছিল আর দশটা দিনের চেয়ে একটু ভিন্ন। দিনভর গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি, সঙ্গে থেমেথমে জলীয় বাষ্প মেশানো ভারী আষাঢ়ে মৌসুমি বায়ুর ঝাপটা। গজারিয়ার ঘন ঝোপ-জঙ্গল আর জনমানব-বিরল প্রকৃতির তরফেও যেন ঘর থেকে বের না হওয়ার উপরোধ।
কিন্তু অটোরিকশাচালক দেলোয়ার তো আর অন্য দশজনের মতো নন। জীবনযুদ্ধের এক কঠিন বাস্তবতার সারথি-পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। হয়তো বউ, ছেলে-মেয়ের ক্ষুধার্ত মুখাবয়বের কল্পনাই সেদিন তাকে প্রকৃতির আহ্বান অগ্রাহ্য করে 'পথে নামার' পথে চালিত করেছিল। বৈরী আবহাওয়াকে পাত্তা না দিয়ে দিন কয়েক আগে অনেক ধার-দেনার নব্বই হাজার টাকায় কেনা তিন চাকার বাহনটির চালকের আসনে বসে যাত্রীর সন্ধানে নেমে পড়েন দেলোয়ার।
চালক ও পরিবহন সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের (এবং পুলিশেরও) জীবনে খুব সাধারণ একটি বাস্তবতা— কাজের চাপে প্রায়ই তারা পরিবার-পরিজনের খোঁজ তেমন রাখতে পারেন না। কিন্তু সদ্য ত্রিশে পা দেওয়া যুবক দেলোয়ার এক্ষেত্রেও অন্যদের চাইতে আলাদা। পেশাগত গণ্ডির বাইরে মানুষ হিসেবে তিনি পুরোদস্তুর সাংসারিক, যা কিছু ঘটুক, রাত দশটার মধ্যে ঘরে ফিরে পরিবারের সঙ্গে রাতের খাবার খাবেনই তিনি। কিন্তু এ দিনটা যে ভিন্ন। দিনের পর রাতও পেরিয়ে যায়, দেলোয়ার ফেরেন না। অনেক খোঁজাখুঁজি শেষে পরদিন সকালে পার্শ্ববর্তী এলাকার এক কলাবাগানে মেলে জবাই করা, ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ভুড়ি বের হওয়া দেলোয়ারের নিথর দেহ। সঙ্গে হাওয়া বহু কষ্টে কেনা তার ডিভাটেক অটোরিকশাটিও।
কাছাকাছি এলাকায় নিকট অতীতে প্রায় একই মডেলের বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। যাত্রীবেশে অটোরিকশায় ওঠা, নির্জন কোনো স্থানে এনে গলা কেটে চালককে হত্যা, তারপর অটোরিকশাটি নিয়ে অজ্ঞাত আততায়ী চক্রের উধাও হয়ে যাওয়া। প্রায় একই পদ্ধতির স্থান নির্বাচন, সময় ব্যবস্থাপনা এবং ধারালো অস্ত্রের ব্যবহার; সবমিলিয়ে এ যেন ভিন্ন ভিন্ন সময়ে একই ঘটনার অবিকল পুনরাবির্ভাবের গল্প। আমার কাছে সবচেয়ে রহস্যজনক লেগেছে, এ এলাকায় যে কটি ঘটনা দেখেছি, গলা কাটার প্রক্রিয়াটি এতটাই নিখুঁত যে, মনে হয় ঘাতক অজস্রবার কাটাকুটি করে এ কাজে হাত পাকিয়েছেন।
ঘাতকেরা এমনই পেশাদার যে, একের পর এক ঘটনা ঘটছে, কিন্তু আমরা কোনো ক্লু পাচ্ছি না, কিছুই করতে পারছি না। সবশেষ দেলোয়ারের গলাকাটা মৃতদেহ উদ্ধার ও অটোরিকশা ছিনতাইয়ের ঘটনা আমাদেরকে রীতিমতো অসহায়ত্বের মুখে ফেলে দেয়। একদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহের ছবির নিচে নেটিজেনরা নিজেদের ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন- ধারাবাহিক সড়ক হত্যাযজ্ঞের কুশীলবদের গ্রেপ্তারে পুলিশের 'নীরব ভূমিকা'র পেছনে নিশ্চয়ই অন্য কারণ! সুস্পষ্ট ইঙ্গিত- অপরাধী চক্রের সঙ্গে আমাদের হাইপোথ্যাটিকাল অবৈধ যোগসাজশ ও সখ্যের দিকে। এদিকে স্থানীয় জনগণ ও যানবাহনের চালকেরাও ক্রমাগত উচ্চকণ্ঠ, তাদের চাওয়া টোয়েন্টিফোর সেভেন সড়কে নিরাপদ চলাচলের বন্দোবস্ত।
একাধিক বার ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও সম্ভাব্য Detection measure অনুসন্ধান করে যা বুঝলাম, ঘাতক চক্র কর্মপরিকল্পনায় ভীষণ নিখুঁত, কর্মপদ্ধতিতে অত্যন্ত দক্ষ। সে দক্ষতা এতটাই যে, পুলিশ সাধারণত অপরাধ ডিটেক্ট করার কাজে যেসব উপাদানের আশ্রয় নিয়ে থাকে (অপরাধীরা সচেতন হয়ে যেতে পারে বিবেচনায় সেসবের বিবরণ উল্লেখ করা হতে বিরত থাকলাম), তার কোনোটার উপস্থিতিই ঘটনাস্থলে নেই।
কথায় আছে না, সেরের ওপরও সোয়া সের থাকে। আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম, যেকোনো মূল্যে এই নৃশংস হত্যা ও ছিনতাইয়ের ধারাবাহিক গল্পের রাশ টানতে হবে, হবেই। আমাদের আন্তরিক প্রচেষ্টা, দীর্ঘদিনের এক পা-দু পায়ের শ্লথ অগ্রযাত্রা এবং গত কয়েক দিনের নির্ঘুম ম্যারাথন কর্মযজ্ঞ দেখে অবশেষে হয়তো মহামহিম পরওয়ারদিগার আমাদের প্রতি সদয় হয়েছেন। পুলিশ সদরদপ্তর ও নরসিংদী জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সার্বিক সহযোগিতায় আলহামদুলিল্লাহ নৃশংস এই ঘাতক চক্রের অভিযুক্ত প্রধান তিন সদস্য ইসমাইল মৃধা ওরফে কসাই ইসমাইল, কবির হোসেন ওরফে ইঞ্জিনিয়ার কবির ও ছোট শাকিল (বলিউডের সেই ছোট শাকিল না কিন্তু এগুলো চক্রের সদস্যদের অভ্যন্তরীণ কোড নাম, যা শুধু সদস্যরাই জানে ও ব্যবহার করে)কে আমরা গ্রেপ্তার করতে পেরেছি। গ্রেপ্তারকৃত কবিরের গ্যারেজ থেকে আমরা উদ্ধার করেছি দেলোয়ারের একমাত্র অবলম্বন সেই ধারদেনার টাকায় কেনা অটোরিকশাটিও।
গ্রেপ্তারের পর আমাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বেশ কয়েকটি খুন-ছিনতাইয়ের ঘটনার সঙ্গে চক্রের সদস্যদের জড়িত থাকার তথ্য মেলে। পরবর্তীতে তাদেরকে আদালতে হাজির করা হলে সেখানে বিচারকের সামনে ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতেও অন্তত দুটি হত্যা ও অটোরিকশা ছিনতাইয়ের ঘটনার সঙ্গে নিজেদের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে বক্তব্য দেন চক্রের অন্যতম প্রধান দুই সদস্য ইসমাইল ও কবির। জঘন্য এই কিলার গ্রুপের অপরাপর সদস্যদের নাগালও আশা করি শিগগিরই পেয়ে যাব আমরা। আর হ্যাঁ, আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সম্ভাব্য জবাবও মিলেছে— দেলোয়ারসহ হত্যার শিকার অন্য চালকদের গলা কাটার প্রক্রিয়াটি এত নিখুঁত ছিল কেন? চক্রের গ্রেপ্তারকৃত অভিযুক্ত দুই সদস্য ইসমাইল ও শাকিল দুইজনই যে পেশায় কসাই! বুঝলাম, দক্ষ হাতে গরু-ছাগল জবাই এবং কাটাকুটির আড়ালে মানুষ জবাইয়ের কাজটিতেও যে তারা হাত পাকিয়েছিলেন বেশ।
আশা করি, চালক ও যাত্রীদের জন্য নরসিংদীর সড়ক এবার নিরাপদ হয়ে উঠবে। ইনশাআল্লাহ ।
প্রতি মুহূর্তে আমাদেরকে আদেশ-উপদেশ, দিকনির্দেশনা প্রদান করে বিশেষ ধন্যবাদার্হ্য হয়েছেন নরসিংদীর পুলিশ সুপার মো. আব্দুল হান্নান স্যার।
জেগে থাকা ও লেগে থাকা যে সাফল্যের চাবিকাঠি- নতুন করে আবারও সেই আপ্তবাক্যের প্রমাণ হাজির করলেন আমাদের টিম সদস্য নরসিংদী জেলা গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) এসআই জসিম উদ্দিন এবং পলাশ থানার এসআই কামরুল ইসলাম। এছাড়াও নির্ঘুম অভিযাত্রায় জোকের মতো লেগেছিলেন আমাদের টিমের অন্য সকল সদস্য। সবাইকে ধন্যবাদ।
লেখক: বিসিএস (পুলিশ), অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল), নরসিংদী
সংবাদটি শেয়ার করুন
ফেসবুক কর্নার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
ফেসবুক কর্নার এর সর্বশেষ

শেকড়ের কাছে

হঠাৎ করে সাইকেল গায়েব এবং উন্নত দেশের পুলিশ ব্যবস্থা

'মিথ্যুক হিযবুতী এজাজের মশা মারতে কামান প্রকল্প ব্যর্থ'

কম্বোডিয়ায় দেখার আছে অনেক কিছু

সাতক্ষীরার জনগণের সাথে ছিলাম, আছি এবং ভবিষ্যৎ থাকবো

দায়িত্ব নিয়েই হেভিওয়েট আ.লীগ নেত্রী গ্রেপ্তার, ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজির প্রশংসায় জুলকারনাইন সায়ের

দ্বাদশ শতকের বিস্ময় অ্যাংকর ওয়াট

আরাকান করিডর- ঐতিহাসিক সুযোগ ও কঠিন ঝুঁকি

`বর্তমান সরকারের সময়ে সাংবাদিকতা চর্চায় এখনো বাধার সম্মুখীন হইনি'
